রেশন নির্বাচন ঘিরে বিএনপির মধ্যে টানাপড়েন দিন দিন বেড়ে চলছে। নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ব্যাপারে বিএনপির কঠোর অবস্থানের কারণে ক্ষুব্ধ দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীরা। বিশেষ করে কাউন্সিলর পদে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের বুঝাতে বেগ পেতে হচ্ছে দলটির শীর্ষ নেতাদের।
এর মধ্যে কাউন্সিলর পদে দলের সম্ভাব্য ২৫ প্রার্থীর নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছে সিলেট মহানগর বিএনপি। এ ছাড়া নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার অনুরোধ জানিয়ে দলের সম্ভাব্য সব প্রার্থীর কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
তবে এতকিছুর পরও বিএনপির অনেক নেতা নির্বাচন করার সিদ্ধান্তে এখন পর্যন্ত অনড় বলে জানা গেছে। এ নিয়ে দলের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে।
বিএনপির সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থীরা বলছেন, কাউন্সিলর পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয় না। এছাড়া কাউন্সিলররা নির্বাচনে দলীয় পদবিও ব্যবহার করেন না। ফলে কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে দলের আপত্তি থাকা উচিত নয়।
মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখার কৌশল হিসেবে কাউন্সিলর প্রার্থীদের ক্ষেত্রে বিএনপি কঠোর অবস্থান নিয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
সিলেট সিটি করপোরেশনের বর্তমান পরিষদে বিএনপির ৮ জন কাউন্সিলর রয়েছেন। এছাড়া মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা।
২১ জুন পঞ্চমবারের মতো সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে আরিফুল হক মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। এছাড়া ৪২টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হতে দলটির শতাধিক নেতা তৎপরতা চালাচ্ছেন।
এদিকে, নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় বিএনপি। কেবল মেয়র নয়, কাউন্সিলর পদেও দলের কেউ যাতে প্রার্থী না হন, সে জন্য কেন্দ্র থেকে স্থানীয় নেতাদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
১০ মে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ভার্চুয়াল সভা করেন সিলেট মহানগর বিএনপির নেতারা। সভায় মেয়র বা কাউন্সিলর পদে দলের কেউ যাতে প্রার্থী না হন, এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেন তারেক রহমান। ওই সভার পরই কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করতে ইচ্ছুক বিএনপির ২৫ নেতার নাম কেন্দ্রীয় মহাসচিবের কাছে জমা দেন স্থানীয় নেতারা।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও দলটির নেতা আরিফুল হক চৌধুরী প্রার্থী হতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। এমন তৎপরতার মধ্যে গত সপ্তাহে ঢাকায় গিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের সাথে দেখা করেন আরিফ। এসময় দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা ফের তাকে জানানো হয়। তখন আরিফুল হক কেন্দ্রীয় নেতাদের জানান, তিনি প্রার্থী না হলেও বিএনপির অনেক নেতা কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হচ্ছেন। এরপর থেকে কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রতি আরও কঠোর হয় বিএনপি।
এর অংশ হিসেবে শনিবার (১২ মে) সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী সাক্ষরিত একটি চিঠি সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থীদের কাছে পাঠানো হয়।
চিঠিতে লেখা হয়, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট বক্তব্য এই যে, পাতানো নির্বাচনে দলের কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মী মেয়র বা কাউন্সিলর পদে নির্বাচন বা কোনো ধরণের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন না। যদি এই পাতানো নির্বাচনে দলের কোনো নেতাকর্মী অংশগ্রহণ করে বা নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন, তবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠিন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
দলের পক্ষ থেকে এমন কঠোর নির্দেশনা পাওয়ার পর বিএনপর সম্ভাব্য অনেক প্রার্থীই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি আবার বিবেচনা করছেন বলে জানা গেছে। আবার অনেকের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
সিলেট মহানগর বিএনপির সর্বশেষ কমিটির সহ-সভাপতি ও ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, ‘আমি টানা চারবারের কউন্সিলর। কোনো নির্বাচনেই আমি দলের পদবি ব্যবহার করিনি। ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা দিয়েই নির্বাচিত হয়েছি। এবার দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে আমি প্রার্থী হতে আগ্রহী নই। কিন্তু, আমার এলাকাবাসী তা মানছেন না; তারা আমাকে প্রার্থী হিসেবে চাচ্ছেন। দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর হিসেবে আমাকে এলাকাবাসীর মতামতকেও গুরুত্ব দিতে হচ্ছে।’
তবে দলের নিষেধ সত্ত্বেও নির্বাচনে প্রার্থী হবেন বলে জানিয়েছেন বিএনপির বর্তমান দুই কাউন্সিলর ১ নম্বর ওয়ার্ডের সৈয়দ তৌফিকুল হাদী ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের জিল্লুর রহমান উজ্জ্বল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক কাউন্সিলর প্রার্থী বলেন, ‘কাউন্সিলর প্রার্থীদেরও নির্বাচন থেকে বিরত রেখে দলেরই ক্ষতি করা হচ্ছে। এতে তৃণমূলে বিএনপি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়বে। এছাড়া দলের বাধা সত্ত্বেও কেউ প্রার্থী হলে তাতে বিএনপির ঐক্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই কাউন্সিলরদের ক্ষেত্রে দলের কিছুটা ছাড় দেয়া প্রয়োজন।’
তবে নির্বাচন প্রশ্নে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না- জানিয়ে সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন বলেন, ‘দল খুব কঠোর অবস্থানে আছে। দলের কোনো পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাই প্রার্থী হতে পারবেন না। প্রার্থী হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
‘দলের কারণেই আমরা আজ নেতা হয়েছি। তাই দলের অবস্থান সবাইকে বুঝতে হবে। দল এই সরকারের বিরুদ্ধে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন চলছে। এখন বিএনপির কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হলে দলের অবস্থানই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’
যে ২৫ সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম কেন্দ্রে
সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে যাদের নাম বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে জমা দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে ৮ জন বর্তমান কাউন্সিলর রয়েছেন।
তারা হলেন নগরেরর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের রেজাউল হাসান লোদী (কয়েস লোদী), ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ফরহাদ চৌধুরী শামীম, ১ নম্বর ওয়ার্ডের সৈয়দ তৌফিকুল হাদী, ১১ নম্বর ওয়ার্ডের রকিবুল ইসলাম ঝলক, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের নজরুল ইসলাম মুনিম, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের এ বি এম জিল্লুর রহমান উজ্জ্বল, ২১ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুর রকিব তুহিন এবং সংরক্ষিত ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর ও মহানগর মহিলা দলের আহ্বায়ক রোকসানা বেগম।
চারজন সাবেক কাউন্সিলরও ওই তালিকায় রয়েছেন। তারা হলেন নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সেলিম আহমদ (রনি), ২২ নম্বর ওয়ার্ডের সৈয়দ মিছবা উদ্দিন, সাবেক সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর ও জেলা মহিলা দলের সভাপতি সালেহা কবির সেফি এবং ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর দিনার খান হাসু।
বাকি ১৩ জন সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থী হলেন নগরীর ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে জেলা বিএনপির উপদেষ্টা গোলাম মোস্তফা কামাল, ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে জেলা যুবদলের সাবেক নেতা সুমন সিকদার ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক বজলুর রহমান, ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে ছাত্রদলের সাবেক নেতা আবদুল হাসিব, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আলতাফ হোসেন সুমন, ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক উসমান হারুন পনির, ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে দিলওয়ার হোসেন, ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে ছাত্রদল নেতা দিলওয়ার হোসেন ও বিএনপি নেতা গৌস উদ্দিন, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে যুবদল নেতা কামাল আহমদ ও বিএনপি নেতা হাবিবুর রহমান, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি মামুনুর রহমান এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. আমীর হোসেন।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ২৩ মে এ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। মনোনয়নপত্র বাছাই ২৫ মে ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১ জুন। আর ২১ জুন ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।