আলোচনাসভায় শেখ হাসিনা
দেশি-বিদেশি যত চাপ আসুক বাঙালি নতি স্বীকার করবে না
আমরাই ভোটের অধিকার নিশ্চিত করব * ১০-১৫ দিনের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ওটা (আমেরিকার ভিসানীতি) নিয়ে আমাদের চিন্তার কিছু নেই। দেশি-বিদেশি যত চাপ আসুক না কেন, তার কাছে বাঙালি নতি স্বীকার করবে না। আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম করে গণতন্ত্র এনেছি। আর গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা আছে বলে দেশে উন্নয়ন হয়েছে। দেশের মানুষের ভোটের অধিকার আমরাই সুরক্ষিত করব। ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বুধবার আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
বিএনপি নেতাকর্মীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দলটি জনগণের ভোটের অধিকারে বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে অন্য কেউ এসে নাগরদোলায় করে তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। কিন্তু দেবে না। ব্যবহার করবে, ক্ষমতায় বসাতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ নাকি আন্দোলন করে আমাদের উৎখাত করবে! ওরা আন্দোলন-সংগ্রাম যা করতে চায় করুক। কিন্তু অতীতের মতো যদি তারা জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসন্ত্রাস করে মানুষ হত্যা করে-তাহলে কিন্তু তারা মার্কিন ভিসা পাবে না। যাদের কথায় তারা নাচে, তারাই তাদের খাবে। আমাদের কিছু করা লাগবে না। ভিসানীতি নিয়ে আমাদের চিন্তার কিছু নেই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা (বিএনপি) আন্দোলন করবে, করুক। তবে নজর রাখতে হবে ২০১৩, ১৪ ও ১৫ বা তার পরবর্তী সময়ে তারা যে অগ্নিসন্ত্রাস করেছে, মানুষ হত্যা করেছে, মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে, হাত-পা কেটেছে, সেটা যেন করতে না পারে। নিজেদের চোখ ক্যামেরা সব সময় ঠিক রাখতে হবে। কারণ ওদের ওই দোষ আছে, একটা উসকানি দিয়ে ছবি তুলে বাইরের দেশের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া যখন গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দেয় তখন আমি একটা কথা বলেছিলাম, আল্লাহতায়ালা জন বুঝে ধন দেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলে গ্যাস একটু পাবেও না, দিতেও পারবে না। সত্যিই দিতে পারেনি। যে কটা কূপ খনন করছে সব শুকনা। কোনো গ্যাস পায়নি, যারা কিনতে চেয়েছিল তারাও নিতে পারেনি।’
বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনসহ আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির নানা সূচক এবং ভবিষ্যতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নানামুখী পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজ পায়ে দাঁড়াতে হবে। পরমুখাপেক্ষী হলে চলবে না। আমরা পরমুখাপেক্ষী হব না। জাতির পিতা ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘যারা গণতন্ত্র হরণ করে হত্যা ক্যু ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে, তাদের পকেট থেকে তৈরি দলের (বিএনপি) নেতারা এখন গণতন্ত্রের কথা বলে, নির্বাচনের কথা বলে, কারচুপির কথা বলে। আরে তোরা তো ভোট ডাকাত, গণতন্ত্র কি তা তোরা জানিস না। জানিস কারফিউ গণতন্ত্র। বাঙালির দুর্ভাগ্য এদের কাছ থেকে গণতন্ত্রের সবক শুনতে হয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘শুনলে আমাদের হাসি পায়, ওরা যখন গণতন্ত্রের কথা বলে। আরে গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটের অধিকার তো সুরক্ষিত করেছে আওয়ামী লীগ। আর খালেদা-তারেক রহমানের অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হয়েছে দেশের মানুষ। বিএনপির দুঃশাসন-দুর্নীতির কথা মানুষ ভুলে যায়নি। একদিকে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন, অন্যদিকে দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলা-এটাই ছিল তাদের কাজ।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভোটের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। ভোটের অধিকার কেউ কেড়ে নিলে জনগণ তাদের ছেড়ে দেবে না। জনগণের আন্দোলনে ভোটচুরির অপরাধে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার দুবার পতন হয়েছে। এটা দেশের মানুষের ভুলে গেলে চলবে না। আওয়ামী লীগ সব সময় জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসেছে। মানুষ ভোট দিতে পারলে আওয়ামী লীগ কখনো পরাজিত হয়নি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা বলেছিলেন, ভিক্ষুক জাতির কোনো ইজ্জত থাকে না। কাজেই আমরা ভিক্ষুক জাতি হব না। বরং অন্যকে খাওয়াব। এটাই আমি চাই। ছয় দফাকে ধরেই আমাদের এগিয়ে যাওয়া। আজকে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশের জনগণকে আর কেউ বাধা দিয়ে রাখতে পারবে না। গণতান্ত্রিক ধারা যেন অব্যাহত থাকে, জনগণের ভোটের অধিকার যেন নিশ্চিত থাকে সেই চেষ্টাই আমরা করব। এজন্য জনগণের কাছে যেতে হবে। উন্নয়নের কথা তুলে ধরতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলতে হবে।’
১৯৭০ সালের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘সে নির্বাচনে মুসলিম লীগ ২০ দলীয় জোট করেছিল, আর আওয়ামী লীগ ছিল একা। তাদের ধারণা ছিল ২০ দলীয় জোট কমপক্ষে ২০টা সিট পাবে। কিন্তু পেয়েছিল মাত্র দুইটা সিট। সমগ্র পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিতে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ সিট পেয়ে যায়। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা মানুষ লুফে নিয়েছিল।
এই ছয় দফা থেকে এক দফার উত্থান। বঙ্গবন্ধু আমাদের বলতেন ছয় দফা তিনি দিয়েছেন। কিন্তু ছয় দফার প্রকৃত অর্থ হলো এক দফা, অর্থাৎ স্বাধীনতা।’
তিনি বলেন, ‘মানুষের কষ্ট হচ্ছে আমরা জানি, তারপরও আমরা বারবার চেষ্টা করছি কষ্ট কীভাবে কমানো যায়। এই কষ্ট শুধু আমাদের একা না, সারা বিশ্বব্যাপী। বৈশ্বিক কারণেই কষ্ট। বাংলাদেশকে আমরা সুন্দরভাবে রেখেছিলাম, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিয়েছিলাম।’
বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তারপরও খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এক ইঞ্চি জমিও পতিত রাখা যাবে না। খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে আমরা রপ্তানি করব। আর রপ্তানির ক্ষেত্রে শুধু গার্মেন্টের ওপর নির্ভর করে থাকব না। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি। ডিজিটাল ডিভাইস তৈরি করব। ইতোমধ্যে অনেক বিনিয়োগ এসেছে। একশটা অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দিয়েছি। সেখানে বিনিয়োগের সুযোগ আসছে। আইসিটি, ডিজিটাল ডিভাইস-এগুলো উৎপাদন করে আমরা রপ্তানি করব।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের অনেক জ্ঞানী-গুণী আছেন, যারা বুদ্ধি বেচে জীবিকা নির্বাহ করেন। আমি বিদ্যুৎ দিয়েছি, তারা এয়ারকন্ডিশন রুমে বসে বক্তৃতা দেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ নেন। প্রাইভেট টেলিভিশনও আওয়ামী লীগ সরকারই দিয়েছে। সেই টেলিভিশনের টক শোতে বসে আলোচনা করেন যে-এই বাজেট আওয়ামী লীগ কোনো দিন কার্যকর করতে পারবে না। আমি স্পষ্ট বলতে চাই, করতে পারব বুঝে শুনেই আমরা বাজেট দিয়েছি। আমরা যা দিয়েছি তা করতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেওয়া বিদ্যুতে, ইন্টারনেটে, এসিরুমে বসে আমাদেরই সমালোচনা করা হয়। আমরা জানি কখন কোন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কখন কোন কথা বলতে হয়। ১০-১৫ দিনের মধ্যে পরিস্থিতির (বিদ্যুৎ) উন্নতি হবে। অতিরিক্ত গরমে মানুষের কষ্ট বুঝতে পারছি আমরা। দুদিনের মধ্যে ৫শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। দশ থেকে ১৫ দিন পর দেশে আর বিদ্যুতের কষ্ট থাকবে না।’
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, মতিয়া চৌধুরী, শাজাহান খান ও সিমিন হোসেন রিমি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি প্রমুখ। সভা সঞ্চালনা করেন দলটির প্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল আউয়াল শামীম।