আগাম বন্যায় হাওরের পাকা ধান ভেসে যেতে পারে—প্রতিবছর এমন শঙ্কা থাকে। কিন্তু এবার এমন শঙ্কার মধ্যেই সুনামগঞ্জের হাওরের প্রায় সব ফসল কাটা হয়ে গেছে। এ মৌসুমে হাওর থেকে ৪০ লাখ টন চাল আসবে।
এবার গরম বেশি থাকায় উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ধান ৮-১০ দিন আগেই পাকতে শুরু করেছে। তাই কাটাও শুরু হয়েছে আগেভাগে। ফলন ভালো হওয়ায় বাজারে চালের দামও কমতে শুরু করেছে। তবে এত সব ভালো খবরের সঙ্গে দুশ্চিন্তা কিছু রয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) হিসাবে, এবার বোরোতে ১ কেজি চাল উৎপাদনের খরচ ৩ টাকা বেড়ে প্রায় ৪১ টাকা হয়েছে। আর ধানের খরচ ২৮ টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৩১ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ধান ও চালে উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের চেয়ে বেশি দামে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও সার কেনায় বোরোয় ওই খরচ বেড়েছে। ফলে কৃষকের ধান ও চালের ভালো দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কা আছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সাত্তার মণ্ডল বোরো ফসলের উৎপাদন পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে ঘুরে আমারও মনে হয়েছে, ধানের উৎপাদন এবার অন্য বছরগুলোর তুলনায় ভালো হবে। তবে সেচ, সার ও কৃষিশ্রমিক বাবদ খরচ বেড়ে যাওয়ায় ধানের উৎপাদন খরচ এবার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়বে। ফলে ধানের দাম যাতে হঠাৎ না পড়ে যায়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এ জন্য সরকারকে দ্রুত সংগ্রহ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আর রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি দরিদ্রদের খাদ্যসহায়তা দেওয়ার বিষয়টিতে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে।’
এদিকে সুনামগঞ্জ জেলায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদিত হয়েছে। গ্রীষ্মকালজুড়ে প্রচণ্ড গরম থাকায় এবার ধানের ফলনও ভালো হয়েছে, পেকেছেও তাড়াতাড়ি। হাওরের প্রায় সব ধান কাটা হয়ে গেছে। দাম ভালো থাকায় কৃষক ওই ধান অল্প অল্প করে বিক্রি করছেন। অন্য বছরগুলোর তুলনায় এবার উৎপাদন ও দাম দুটিই ভালো।
এ ব্যাপারে কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, ‘আমরা মাঠপর্যায়ে নিয়মিত তদারক করছি। এবার আমাদের বোরোতে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ টন। আশা করি, ২ কোটি ২০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হবে। ধান কাটার আগে বড় কোনো দুর্যোগ না হলে এবার আশা করি, দেশে চাল আমদানি করা লাগবে না।’
উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবার সরকার ধান ও চালের সংগ্রহ মূল্য বাড়িয়েছে। প্রতি কেজি ধান ৩০ টাকা ও চাল ৪৪ টাকা নির্ধারণ করেছে। চাল কেনা হবে মূলত চালকলের মালিকদের কাছ থেকে। আর ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। চালকলের মালিকেরা সরকারের কাছে প্রতি কেজি চাল বিক্রি করে তিন টাকার বেশি মুনাফা পাবেন। আর ধানের উৎপাদন খরচ ও সংগ্রহ মূল্য প্রায় সমান রাখা হয়েছে।
খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমরা মূলত চাল সংগ্রহের ওপর জোর দেব। আশা করি, লক্ষ্য অনুযায়ী সংগ্রহ করা যাবে। আর সরকারিভাবে ধান সংগ্রহের বিষয়টি আমরা পর্যায়ক্রমে বাড়াব। ধান সংগ্রহের জন্য বিশেষায়িত গুদাম তৈরি করছি। তখন সংগ্রহ বাড়বে।’ ধান সংগ্রহের মূল্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের একটি বার্তা। এর কমে যাতে বিক্রি না হয়।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এবার বোরো ধানের উৎপাদন ভালো হয়েছে এটা ঠিক; কিন্তু এই ফসল চাষের পুরো সময়ে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম বৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রায় খরা পরিস্থিতি ছিল। অনেক এলাকায় ভূগর্ভের পানি বেশি তুলে বাড়তি সেচ দিতে হয়েছে।
ফলে সামগ্রিকভাবে আমাদের জন্য বোরো ধানের চাষ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আমাদের বোরো ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে, যাতে পানি কম লাগে। আর আমনে উৎপাদন বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। নয়তো দেশের ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।’