রূপকথার রাজা, রাজকুমার রাজকন্যার গল্প শোনে শোনে কেটে গেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে এখনো টিকে আছে যুক্তরাজ্যের রাজতন্ত্র। দীর্ঘ ৭০ বছর রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজত্বের অবসানের পর, ৬ মে (শনিবার) ব্রিটেনের নতুন রাজ মুকুট মাথায় উঠবে রাজা তৃতীয় চার্লসের। লন্ডনে ওয়েস্ট মিনস্টার অ্যাবের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে তার আনুষ্ঠানিক অভিষেক হবে ব্রিটেনের ৪০তম রাজা হিসেবে। রাজকীয় আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাকিংহাম প্যালেস। ইতিহাসের সাক্ষী হতে প্রাসাদের সামনে ভিড় করছে রাজ পরিবারের ভক্তরাও। সাজানো হয়েছে ৩ দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান মালা।
যুক্তরাজ্যের নতুন রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঐতিহাসিক প্যারেডে অংশ নেবেন নৌ, বিমান ও সেনাবাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য। রাইফেল, তলোয়ার, পতাকা হাতে চলছে মহড়া। কমনওয়েলথভুক্ত নিউজিল্যান্ড, ব্রুনাই, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকেও এসেছে সেনারা। অভিষেক উপলক্ষে সোমবার অতিরিক্ত ব্যাঙ্ক হলিডে ঘোষণা করেছে সরকার। কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন শহরে ও অলিতে গলিতে অনুষ্ঠিত হবে স্ট্রিট পার্টি। উইন্ডসর ক্যাসেলে হবে করোনেশন কনসার্ট। হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রস্তুত রয়েছে একাধিক রাজকীয় আসন। ৭শ’ বছর আগে তৈরি করা ঐতিহাসিক সেন্ট এডওয়ার্ড চেয়ার থাকছে। ১৩০৮ সালে রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ডের অভিষেকে ব্যবহৃত হয়েছিল এটি। এবার তৃতীয় চার্লসের মুকুট পরার মুহূর্তের সাক্ষী হতে যাচ্ছে আসনটি। এছাড়াও আয়োজনের নানা পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে কুইন কনসর্ট ক্যামিলা ও কিং চার্লসের বসার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে চেয়ারস অব স্টেট, থ্রোন চেয়ারস।
রাজা তৃতীয় চার্লসের মাথায় সেন্ট এডওয়ার্ডের মুকুট পরিয়ে দেবেন আর্চ বিশপ। স্বর্ণের এই মুকুটটি তৈরি করা হয়েছিল ১৬৬১ সালে। রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানের অতিথিদের তালিকা তৈরি হয়েছে আরও আগেই। পৌঁছে গেছে দাওয়াতপত্রও। ১৬৯০ সালের দিকে তৈরি বিশেষ সোনালি বাহন শেষ ব্যবহার করা হয়েছিল ১৯৮১ সালে, প্রিন্স চার্লস ও লেডি ডায়ানার বিয়ের সময়। এবার রাজার অভিষেক আয়োজন উপলক্ষে প্রদর্শন করা হচ্ছে তা।
ইতিহাসের সাক্ষী হতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ভক্তরাও। তাবু, ফোল্ডাবেল বেড, ব্যাগ, খাবারদাবার নিয়ে তারা বসে পড়েছেন প্রাসাদের কাছাকাছি। ভক্তরা বলছেন, অভিষেক অনুষ্ঠান পর্যন্ত ধৈর্য্য রাখতে পারছি না। রাজা-রানি সোনালি আসনে এখান থেকে যাবেন। আমরা লাল-সাদা-নীল পতাকা নাড়বো। লাখ লাখ মানুষ মেক্সিকান ওয়েভে অংশ নেবো। গত সেপ্টেম্বরে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর রাজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তৃতীয় চার্লস। রাষ্ট্রপ্রধান হলেও যুক্তরাজ্যে রাজার ক্ষমতা মূলত প্রতীকী।
অভিষেক অনুষ্ঠানে যা যা হবে:
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে অভিষেক অনুষ্ঠানে রাজা ও কুইন কনসর্টকে মুকুট পরানো হবে। আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবরি ওই অভিষেক অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন।
অভিষেক অনুষ্ঠানে রাজার মাথায় ও হাতে ‘পবিত্র তেল’ লেপন করা হবে এবং রাজকীয় প্রতীক হিসেবে তিনি রাজদণ্ড ও রাজগোলক গ্রহণ করবেন।
অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত পর্বে রাজা তৃতীয় চার্লসের মাথায় সেন্ট এডওয়ার্ডের মুকুট পরিয়ে দেবেন আর্চবিশপ। স্বর্ণের এই মুকুটটি ১৬৬১ সালে তৈরি করা।
রাজকীয় অনুষ্ঠানের জন্য টাওয়ার অব লন্ডনে যেসব সামগ্রী বা ক্রাউন জুয়েলস সংরক্ষিত আছে তার অন্যতম এই এডওয়ার্ড মুকুট।
শুধুমাত্র অভিষেক অনুষ্ঠানে রাজা বা রানি এই মুকুট পরে থাকেন।
রাজার অভিষেক একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান এবং ব্রিটিশ সরকার এর খরচ বহন করবেন। কারা এই অনুষ্ঠানে অতিথি হবেন সেই তালিকাও সরকার তৈরি করবে।
আসবেন না আমেরিকার প্রেসিডেন্ট -
ইতিহাসবিদেরা বলছেন, চার্লসের রাজ্যাভিষেকে জো বাইডেনের যোগ না দেওয়াটা যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে বেশি ঐতিহাসিক। কেন না, ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো ব্রিটিশ রাজা–রানির রাজ্যাভিষেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের অংশ নেওয়ার নজির নেই।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক ও আধুনিক ব্রিটেনবিষয়ক বিশ্লেষক লরা বিয়ার্স বলেন, ‘চার্লসের রাজ্যাভিষেকে তিনি (বাইডেন) যাচ্ছেন না। কারণ, এর আগে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট যাননি।’
রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্ব শুরুর আগে ১৮১২ সালে ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকান গৃহযুদ্ধের উত্তেজনাও ছিল। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। ১৮৩৭ সালে ভিক্টোরিয়া যখন সিংহাসনে বসেন, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন মার্টিন ভ্যান বুরেন। তিনি ভিক্টোরিয়ার অভিষেক অনুষ্ঠানে যাননি।
এ বিষয়ে লরা বিয়ার্স বলেন, ‘ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ব্রিটিশ রানির অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন, সেটা বাস্তবসম্মত ছিল না। পরে সেটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়।’
ভিক্টোরিয়ার পর থেকে দ্বিতীয় এলিজাবেথের আগপর্যন্ত একে একে ব্রিটিশ সিংহাসনে বসেন রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড (১৯০১), পঞ্চম জর্জ (১৯১০), অষ্টম এডওয়ার্ড (১৯৩৬), ষষ্ঠ জর্জ (১৯৩৬)। তাঁদের কারও অভিষেকেই তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্টদের দেখা যায়নি।
রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেকে মোট ১৩০০ কোটি টাকা (১০০ মিলিয়ন পাউন্ড) খরচ হবে। এমন চাঞ্চল্যকর পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম টাইম ম্যাগাজিন। সব ব্যয়ভার বহন করবে ব্রিটিশ সরকার। দেশের আর্থিক সংকটের মধ্যে এহেন খরচের ভার চাপানো নিয়ে ক্ষুব্ধ ব্রিটেনের সাধারণ মানুষ। রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানের দিনই বিক্ষোভ দেখানোরও পরিকল্পনা করেছেন রাজতন্ত্রের বিরোধীরা। খবর এনডিটিভির
জানা গেছে, অপারেশন গোল্ডেন অর্ব কমিটি নামে একটি সংস্থাকে রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের তরফেই জানানো হয়েছে, ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ হবে অনুষ্ঠানে।
যেহেতু এটি সরকারি অনুষ্ঠান, তাই যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতে হবে প্রশাসনকেই। সাধারণ মানুষের করের টাকা কেন এই অনুষ্ঠানে খরচ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্রিটিশরা। ৬ মে রাজ্যাভিষেক হবে তৃতীয় চার্লসের। ওইদিন গোটা ব্রিটেনজুড়ে সব ব্যাংক বন্ধ থাকবে। সেই কারণেও বিশাল ক্ষতি হবে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে।ইতোমধ্যেই একাধিক বিতর্ক দানা বেঁধেছে এই অনুষ্ঠান ঘিরে। রাজতন্ত্রের বিরোধী সংগঠনগুলো অনুষ্ঠানের দিনে দেশজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। একটি সংগঠনের তরফে বলা হয়েছে, ‘বংশ পরম্পরায় দেশের প্রধান হচ্ছেন কেউ, সেটা গণতন্ত্রবিরোধী।
উল্লেখ্য, দীর্ঘ সত্তর বছর রাজত্ব করার পর ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী রাজশাসক রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্যালমোরাল প্রাসাদে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।অন্যদিকে ১৯৫৩ সালে এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের খরচ ছিল ৯ লাখ ১২ হাজার পাউন্ড যা আজ ২৬ মিলিয়ন ডলারের সমান।
সাম্প্রতিক দিনগুলিতে, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু যেভাবে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এবং বিশ্বজুড়ে মিডিয়া তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং নতুন রাজা তৃতীয় চার্লসের উত্তরাধিকারের প্রক্রিয়াটিকে যেভাবে সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করেছে, তাতে রাজতন্ত্রের আকর্ষণ করার ক্ষমতাটি স্পষ্ট দেখা গেছে। রানিকে বিদায় জানাতে আসা জনতার দীর্ঘ লাইন ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে দ্বিতীয় এলিজাবেথ এবং রাজতন্ত্রের প্রবল জনপ্রিয়তার সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
এমনটা অবশ্য প্রত্যাশিতই ছিল। যেমন, মার্চের মাঝামাঝিতে ব্রিটেনে ইউগভ নামে জরিপ সংস্থার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উত্তরদাতাদের মধ্যে ৮১ শতাংশের কাছে রাজতন্ত্র ইতিবাচক।
রাজতন্ত্রের উত্থান পতন
ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ও বহু উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়ে আছে।
৪১০ সালের দিকে ইংল্যান্ডে রোমান সাম্রাজ্যের অবসান হয়ে নতুন এই রাজতন্ত্র শুরু হয়। পার্লামেন্ট ইংরেজ রাজা এবং তার সরকারের দৈনন্দিন রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করত।
১৬৪২ সালে, রাজা এবং ইংরেজ পার্লামেন্টের মধ্যে দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে এবং গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৬৪৯ সালে রাজার মৃত্যুদণ্ড, ইংরেজ রাজতন্ত্রের উৎখাত এবং ইংল্যান্ডের কমনওয়েলথ প্রতিষ্ঠায় গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। সতেরশো শতকে এমনও এক সময় ছিল যখন ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। সেটি ছিল রাজা প্রথম ও দ্বিতীয় চার্লসের শাসনের মাঝখানের এক দশক। এবং ১৬৪৯ থেকে ১৬৬০ সালের মধ্যে এমন কোনও সরকার ক্ষমতায় ছিল না যার পক্ষে ব্যাপক-ভিত্তিক জনসমর্থন ছিল। তখন প্রথম চার্লস কে রাষ্ট্রদোহীতার অভিযোগে প্রকাশ্যে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল। কাকতালীয়ভাবে, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস এখন রাজা হয়ে তৃতীয় চার্লস নাম গ্রহণ করেছেন।
মূলত ১২১৫ সালে ম্যাগনা কার্টা চুক্তির মাধ্যমে প্রাচীন রাজতন্ত্রের বিলুপ্ত ঘটার মধ্য দিয়ে আধুনিক রাজতন্ত্রের সূচনা হয়। এবং এটিই ইতিহাসের প্রথম দলিল যা এই নীতিটি লিখিত করেছিল যে রাজা এবং তার সরকার আইনের ঊর্ধ্বে নয়। যা রাজকীয় কর্তৃত্বের সীমাবদ্ধতা স্থাপন হয়েছিল। ঐতিহ্যের ধারক ইংরেজ জাতি তাদের ঐতিহ্য হিসাবে রাজতন্ত্রকে ভালবেসে৷ যা এখনো টিকিয়ে রেখেছে।